কিছু কাজ ও কারণে রিজিক ক্ষতিগ্রস্তও হয়, যার ফলে আয় রোজগার ভালো হওয়া সত্ত্বেও যেন অভাব দূর হয় না। আর এ অভিযোগ অনেকের মুখেই শুনে থাকি ।
১) পাপাচার: ( Immorality )
মানুষের গোনাহের কারণে যেমন মানুষের আজাব-গজব নাজিল হয়, তেমনি জীবিকার বরকত দূরীভূত হয়ে যায়। ইরশাদ হয়েছে,
‘যদি সেসব জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত ও তাকওয়া অবলম্বন করত তাহলে আমি তাদের জন্য আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর বরকত (কল্যাণ ও প্রাচুর্য) উন্মুক্ত করে দিতাম। কিন্তু তারা প্রত্যাখ্যান করেছিল, সুতরাং তাদের কৃতকর্মের জন্য তাদের শাস্তি দিয়েছি।’ –সূরা আরাফ: ৯৬
২) প্রতারণা ও ধোঁকা: ( Fraud and deception )
মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করলে এবং তাদের ধোঁকা দিলে সম্পদের বরকত চলে যায়। হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘ক্রেতা-বিক্রেতা যতক্ষণ পরস্পর বিচ্ছিন্ন না হয়, ততক্ষণ তাদের এখতিয়ার থাকবে (ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন কিংবা বাতিলের)। যদি তারা সত্য বলে এবং (পণ্যের) অবস্থা ব্যক্ত করে, তাহলে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত হবে। আর যদি মিথ্যা বলে এবং (পণ্যের) দোষ গোপন করে তাহলে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ের বরকত মুছে ফেলা হয়।’ –সহিহ বোখারি: ২০৭৯
পণ্যের বা যেকন জিনিসের দোষ-ত্রুটি গোপন করে তা বিক্রি করা ক্রেতাকে ধোঁকা দেওয়ার শামিল। যার কারণে সম্পদের বরকত চলে যায়।
৩) বেশি বেশি কসম খাওয়া: ( Swear too much )
মানুষ নিজের কথাকে অন্যের কাছে বিশ্বস্ত করে তোলার জন্য কসম খায় । প্রয়োজনে কিংবা অপ্রয়োজনে অধিক কসম খাওয়া মোটেও উচিত নয়। মিথ্যা কসম খাওয়া বড় ধরনের পাপ, যার কারণে সম্পদের বরকত চলে যায়। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
‘তোমরা ক্রয়-বিক্রয়ে অধিক কসম করা থেকে সাবধান থেকো। কেননা নিশ্চয়ই তাতে (মিথ্যা কসমে) বিক্রি বেশি হয় কিন্তু পরে (বরকত) ধ্বংস করে।’ –সহিহ মুসলিম: ২৭৯৩
৪) সুদের আদান-প্রদান: ( giving and receiving of Interest )
সম্পদ বাড়ানোর জন্য মানুষ সুদ গ্রহণ ও প্রদান করে থাকে । অথচ সুদের আদান-প্রদানে জীবিকার বরকত দূর হয়ে যায়। আল্লাহতায়ালা বলেন,
‘আল্লাহ সুদকে নিঃশেষ করেন ও সদকায় প্রবৃদ্ধি দান করেন…।’ -সূরা বাকারা: ২৭৬
৫) নিয়ামতের শোকরিয়া আদায় না করা: ( Not thanking for blessings )
আল্লাহতায়ালা তার অশেষ অশেষ নিয়ামত দ্বারা আমাদের ঘিরে রেখেছেন। রিজিক হচ্ছে তার অন্যতম নিয়ামত। এসব নিয়ামতের শোকরিয়া আদায় না করলে বরকত ও কল্যাণ কোন ভাবেই লাভ করা যায় না। আল্লাহতায়ালা বলেন,
‘যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো, তা হলে আমি অবশ্যই তোমাদের বেশি বেশি করে দেব। আর যদি অকৃতজ্ঞ হও, তাহলে (মনে রেখো) নিশ্চয়ই আমার শাস্তি অত্যন্ত কঠোর।’ –সূরা ইবরাহিম: ৭
৬) কৃপণতা ও ব্যয়কুণ্ঠতা: ( Miserliness and wastefulness )
কৃপণতা ও বখিলতা মানুষকে পাপাচারে লিপ্ত করে, যা ইহকালীন ও পরকালীন জীবনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণ। নবী করিম (সা.) বলেন,
‘তোমরা কৃপণতার ব্যাপারে সাবধান হও। কেননা তোমাদের পূর্ববর্তীরা কৃপণতার কারণে ধ্বংস হয়েছে। অর্থলোভ তাদের কৃপণতার নির্দেশ দিয়েছে, ফলে তারা কৃপণতা করেছে। তাদের আত্মীয়তা ছিন্ন করার নির্দেশ দিয়েছে, তখন তারা তা-ই করেছে এবং তাদের পাপাচারে প্ররোচিত করেছে, তখন তারা তাতে লিপ্ত হয়েছে।’ –সুনানে আবু দাউদ: ১৬৯৮
৭) প্রাপ্ত রিজিক ও তাকদিরে সন্তুষ্ট না থাকা:
মহান আল্লাহতায়ালা বান্দাদের জন্য রিজিক বণ্টন করে থাকেন। মানুষ আল্লাহপ্রদত্ত রিজিকের ওপর সন্তুষ্ট থাকলে তার জীবিকায় বরকত লাভ হয়। পক্ষান্তরে ওই রিজিকের ওপর সন্তুষ্ট না হলে জীবিকার বরকত চলে যায়। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
‘আল্লাহ বান্দাকে প্রদত্ত জিনিসের মাধ্যমে পরীক্ষা করে থাকেন। আল্লাহ তার জন্য যা নির্ধারণ করেছেন, তাতে যদি সে সন্তুষ্ট থাকে, তাহলে আল্লাহ তাতে বরকত দান করেন এবং তাকে বৃদ্ধি করে দেন। আর যদি সন্তুষ্ট না থাকে তাহলে তাতে আল্লাহ তায়ালা বরকত দেন না।’ -মুসনাদে আহমাদ: ২০২৭৯
৮) অপচয় ও অপব্যয়: ( Wasting and wasting )
বাজে কাজে ও অপ্রয়োজনে খরচ নির্ঘাতই অপব্যয়। এটা মানুষের নিন্দনীয় স্বভাব, যার কারণে তার মধ্যে চৌর্যবৃত্তি, অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ, উৎকোচ গ্রহণ ইত্যাদি দুশ্চরিত্রত স্বভাব বিস্তার করে। এ জন্য ইসলাম এগুলো নিষিদ্ধ করেছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন,
‘তোমরা খাও ও পান করো। কিন্তু অপচয় করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের ভালোবাসেন না।’ -সূরা আরাফ: ৩১
৯) জাকাত না দেওয়া: ( Not paying zakat )
জান ও মালের জাকাত আদায় ফরজ জানা সত্ত্বেও অনেকে তা আদায় করে না ফলে ইহকালীন ও পরকালীন আজাব গজব আপতিত হয়। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
‘যখন কোনো জাতি জাকাত আদায় করে না তখন আসমান থেকে বৃষ্টি বন্ধ করে দেওয়া হয়। যদি ভূপৃষ্ঠে চতুষ্পদ জন্তু ও নির্বাক প্রাণী না থাকত তাহলে আর কখনও বৃষ্টি হতো না।’ -ইবনে মাজা: ৪০১৯
সম্পদের হক হচ্ছে জাকাত দেওয়া। এ হক প্রদান করলে সম্পদে বরকত হয়, অন্যথায় বরকত দূরীভূত হয়ে যায়।
১০) অন্যায় পথে সম্পদ অর্জন করা: ( Gaining wealth through unfair means )
হারাম ও অন্যায় ভাবে সম্পদ অর্জন করলে তার বরকত দূরীভূত হয়ে যায়। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
‘যে ব্যক্তি সংগত পন্থায় সম্পদ অর্জন করে তাকে বরকত দান করা হয়। আর যে ব্যক্তি অসংগত পন্থায় সম্পদ অর্জন করে সে এমন ব্যক্তির মতো যে আহার করে, কিন্তু তৃপ্ত হয় না।’ –সহিহ মুসলিম: ১০৫২
আমাদের জীবিকায় বরকত লাভ এবং অব্যাহত থাকার জন্য উপরোক্ত কাজগুলো পরিহার করা উচিত।
রিজিকের স্তর ।
রিজিকের বহু বা নানাবিধ অর্থ আছে। অর্থাৎ
রিজিকের বহু স্তর আছে। বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য কোরআন-হাদিসের আলোকে নিম্নে রিজিকের কয়েকটি স্তর তুলে ধরা হলো—
ঈমান : বান্দার সফল হওয়ার সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো ঈমান। ঈমানের চেয়ে বড় রিজিক ও নিয়ামত আর কিছু হতে পারে না।
বলুন, তোমরা ইসলাম গ্রহণ করে আমাকে ধন্য করেছ মনে কোরো না; বরং আল্লাহই ঈমানের দিকে পরিচালিত করে তোমাদের ধন্য করেছেন, যদি তোমরা সত্যবাদী হও। (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১৭)
অর্থ-সম্পদ : অর্থ-সম্পদও রিজিকের একটি অন্যতম শাখা। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আল্লাহ তোমাদের যে সম্পদ দিয়েছেন তা থেকে তোমরা তাদের দান করো।’ (সুরা : নূর, আয়াত : ৩৩)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে,
‘আর আল্লাহ জীবনোপকরণে তোমাদের মধ্যে কাউকে কারো ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। যাদের শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়েছে তারা তাদের অধীন দাস-দাসীদের নিজেদের জীবনোপকরণ থেকে এমন কিছু দেয় না, যাতে ওরা এ বিষয়ে তাদের সমান হয়ে যায়। তবে কি তারা আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকার করছে?’ (সুরা : নাহাল, আয়াত : ৭১)
হিকমত (প্রজ্ঞা) : হিকমত ও প্রজ্ঞা আল্লাহর অমূল্য নিয়ামত এটি অর্জন করার সৌভগ্য সবার হয় না।
মহান আল্লাহ দয়া করে যাকে দেন, সে-ই তা অর্জন করতে পারে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে,
‘তিনি যাকে ইচ্ছা প্রজ্ঞা দান করেন এবং যাকে প্রজ্ঞা দান করা হয় সে নিশ্চয়ই প্রচুর কল্যাণ লাভ করে। আসলে জ্ঞানবান ব্যক্তিরা ছাড়া কেউ উপলব্ধি করতে পারে না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৬৯)
সুস্বাস্থ্য : সুস্বাস্থ্য আল্লাহপ্রদত্ত গুরুত্বপূর্ণ রিজিক। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন,
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
এমন দুটি নিয়ামত আছে, যে ব্যাপারে বেশির ভাগ মানুষ ধোঁকায় পতিত—সুস্বাস্থ্য ও সুসময় বা অবসর। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪১৭০)
নেককার স্ত্রী : আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.)- থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন,
‘গোটা পৃথিবী মানুষের ভোগ্যবস্তু, আর পৃথিবীর ভোগ্য বস্তুসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম হলো পুণ্যবতী স্ত্রী।’ (নাসায়ি, হাদিস : ৩২৩২)
আরো পড়ুন : যেসব লক্ষণ দেখলে বুঝবেন যে আপনি থাইরয়েডের শিকার !!!
সন্তান সন্ততি : নেক সন্তান মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সর্বোত্তম উপহার যা আমার বুঝতে পারি না ।
ইরশাদ হয়েছে, ‘ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দুনিয়ার জীবনের শোভা...।’ (সুরা : কাহফ, হাদিস : ৪৬)
ঈমানদারদের ভালোবাসা : ঈমানদারদের ভালোবাসাও শ্রেষ্ঠ রিজিক। কারণ আল্লাহ যাকে ভালোবাসেন, তার প্রতি ঈমানদারদের মনে ভালোবাসা সৃষ্টি করে দেন।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন,
‘আল্লাহ যখন কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন, তখন তিনি জিবরাইলকে ডেকে বলেন, আল্লাহ অমুক বান্দাকে ভালোবাসেন, তাই তুমিও তাকে ভালোবাসো। কাজেই জিবরাইল (আ.) তাকে ভালোবাসেন। অতঃপর জিবরাইল (আ.) আসমানে এই ঘোষণা করে দেন যে আল্লাহ অমুক বান্দাকে ভালোবাসেন, তোমরাও তাকে ভালোবাসো। তখন তাকে আসমানবাসীরা ভালোবাসে এবং পৃথিবীবাসীদের মধ্যেও তাকে গ্রহণীয় করা হয়।’ (বুখারি, হাদিস : ৭৪৮৫)
FAQ Page, ( Question , Answer )
১. তাকওয়া ও তাওয়াক্কুল অবলম্বন করা
২. পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা
৩. তওবা ও ইস্তিগফার করা
৪. আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করা
৫. বারবার হজ-ওমরাহ করা
৬. অসহায়ের প্রতি সদয় আচরণ
- ঈমান
- অর্থ-সম্পদ
- হিকমত (প্রজ্ঞা)
- সুস্বাস্থ্য
- নেককার স্ত্রী
- সন্তান-সন্ততি
- ঈমানদারদের ভালোবাসা
প্রশ্ন - আর কি করলে রিজিক বা সম্পদে বরকত লাভ হয় ?
0 Comments